আবাবিল (Swallow) :


আবাবিল (Swallow)  গায়ক পাখির নির্দিষ্ট একটি গোত্রের সকল পাখিদের সাধারণ বাংলা নাম। সাধারণত, হাইরানডিনিডি (Hirundinidae) গোত্রের পাখিদের আবাবিল বলা হয়। আবার পারিডি (Paridae) গোত্রের পাখিরাদেরও অনেকসময় আবাবিল বলা হয়। আবার কেবল হাইরানডু গণের পাখিদেরও আবাবিল বলা হয়। হাইরানডিনিডি গোত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এদের লম্বা সরু পাখা এবং দ্বিধাবিভক্ত পা। আবাবিল পোকামাকড় খেয়ে জীবনধারণ করে। এদের প্রায়ই দলবদ্ধভাবে আকাশে উড়তে দেখা যায়। এরা খুব পারদর্শীতার সাথে আকাশে উড়তে, পাক দিতে এবং ঘুরতে সক্ষম। হাইরানডিনিডি গোত্রে প্রায় ৮৯টি প্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশে এর ৩টি গণে ১০টি প্রজাতি রয়েছে।


বর্ণনা:
আবাবিল এবং নাকুটি পাখিদের শারীরিক গঠন বিবর্তন প্রক্রিয়ায় খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি। অর্থাৎ খানিকটা রক্ষণশীল রয়ে গেছে। তাই গায়ক পাখিদের অন্য পরিবারগুলোর সাথে তাই এদের বেশ পার্থক্য করা যায়। এদের দেহ মসৃণ এবং পাখার প্রান্ত সূক্ষ্ম হওয়াতে এর শারীরিক গঠন ওড়ার জন্য সহায়ক। এদের উড্ডয়ন ক্ষমতা অনেক বেশি। একই আয়তনের অন্য গায়ক পাখি চাইতে এরা ৫০-৭৫ শতাংশ শক্তি কম খরচ করে উড়তে পারে। আবাবিলের ঠোঁট অনেকটা বাতাসি (ইংরেজি: Swift) এবং দিনেকানা (ইংরেজি: Nightjar) এর মতো ছোট সুঁচালো। এদের দেহ লম্বায় ১০-২৪ সে.মি. এদের ওজন ১০-৬০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। এদের লেজ ১২টি পালক দিয়ে গঠিত। ধারণা করা হয়, এদের লেজ অনুরাগের সময় আকর্ষণীয়তা বৃদ্ধি করে যেহেতু পুরুষ পাখির লেজ প্রায়শই অধিকতর লম্বা হয়ে থাকে। মেঠো আবাবিলের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুরুষ পাখির লেজ স্ত্রী পাখির তুলনায় ১৮ শতাংশ লম্বা এবং সঙ্গী নির্বাচনের সময় লেজের দৈর্ঘ্য দিয়ে স্ত্রী পাখি পুরুষ পাখির আকর্ষণীয়তা বিচার করে। গঠনগত দিক থেকে আবাবিলের দুর্বল দিক হচ্ছে এদের পা, যা ছোট আকৃতির এবং এজন্য এদের পক্ষে গাছ আঁকড়িয়ে ধরে রাখা খুবই কষ্টসাধ্য। এদের জন্য সবচেয়ে সহজ আঁকরানোর স্থান হলো টেলিফোনের তার। এরা আবহাওয়া পূর্বাভাসের পাখি হিসেবে খ্যাত।


মানুষ ও আবাবিল :
আবাবিল বিষয়ক বেশ কিছু রূপকথা চালু আছে বিভিন্ন সমাজে। পাখিটিকে কাজেও ব্যবহার করেছেন অনেকে। আবাবিলকে ঘোড়দৌড়ের রেফারি করতে দেখা গেছে এমনটি লিখেছেন প্রাচীন রোমের ঐতিহাসিক প্লেইনি দ্য এল্ডার। জিন ডেসবাউভ্রি নামক একজন জীববিজ্ঞানী আবাবিলকে বার্তাবাহক পাখি হিসেবে শিক্ষা প্রদানের চেষ্টা করেন এবং সফল হন। তিনি কবুতরের বিকল্প হিসেবে আবাবিলকে ব্যবহারের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলেন। উড়োজাহাজ নির্মানকালে আবাবিল অনেক দেশে মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুটি যুদ্ধবিমানের নামও আবাবিলের নামে হয়। সমুদ্রের নাবিকদের কাছে আবাবিল একটি ভালো চিহ্ন অনেককাল ধরে। আবাবিল দেখা মানে তাদের কাছে তীরের সন্ধান পাওয়া।

মুসলমানদের কাছে আবাবিল পবিত্র পাখি। সাধারণত তারা আবাবিল মারে না। কেননা বর্ণিত আছে যে, আব্রাহা ইবনে আল সাবাহ পবিত্র ক্বাবা শরীফ ধ্বংসের জন্য মক্কার দিকে ধাবিত হয়। এই আক্রমণ বানচাল করতে "বিশাল এক আবাবিলের দল ছোট ছোট পাথর বহন করে সমুদ্র থেকে উড়ে আসে এবং আব্রাহার লোকদের মাথার উপর নিক্ষেপ করে। আঘাত পাওয়া প্রত্যেক ব্যক্তির মৃত্যু হয়।


আবাবিলের প্রজাতি ও শ্রেণীবিন্যাস :
আবাবিলের শারীরিক গঠন অন্যান্য গায়ক পাখি থেকে ভিন্ন হলেও, চশমাপাখি (white-eye) এবং ফুটফুটির (warbler) সাথে এর কিছু মিল দেখা যায়। হাইরানডিনিডি পরিবারেও দুটি উপপরিবারের মাঝে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। এর ৮১টি প্রজাতি আছে (কারো কারো মতে ৮৯টি)  স্বাভাবিকভাবেই সব প্রজাতির বাংলা নামকরণ হয়নি।


 
বাংলাদেশে আবাবিলের প্রজাতি :
বাংলাদেশে আবাবিলের অর্থাৎ হাইরানডিনিডি গোত্রে যেসমস্ত প্রজাতি দেখা যায় সেগুলো হলো :


* ম্লান নাকুটি, ইংরেজি: Pale Martin (Riparia diluta)
* নাকুটি, ইংরেজি: Brown-throated Martin (Riparia paludicola)
* বালি নাকুটি/ নাককাটি, ইংরেজি: Sand Martin (Riparia riparia)
* লালকোমর আবাবিল, ইংরেজি: Red-rumped Swallow (Hirundo daurica)
* দাগিগলা আবাবিল, ইংরেজি: Strak-throated Swallow (Hirundo fluvicola)
* মেঠো আবাবিল/ আবাবিল, ইংরেজি: Barn Swallow (Hirundo rustica)
* তারলেজা আবাবিল/ তারলেজা, ইংরেজি: Wire-tailed Swallow (Hirundo smithii)
* দাগি আবাবিল, ইংরেজি: Striated Swallow (Hirundo striolata)
* এশীয় ঘরনাকুটি, ইংরেজি: Asian House Martin (Delichon dasypus)
* নেপালি ঘরনাকুটি, ইংরেজি: Nepal House Martin (Delichon nipalensis)


     নাকুটি পাখি বা বাদামি-গলা মার্টিন



পশ্চিমবঙ্গে আবাবিলের প্রজাতি :

বাংলাদেশের সকল আবাবিল প্রজাতি পশ্চিমবঙ্গেও দেখা যায়। তবে সেখানে তারলেজা আবাবিল (ইংরেজি: Wire-tailed Swallow;Hirundo smithii) বেশি পরিচিত। ভারতের সর্বত্রই তারের উপর এদের বসে থাকতে দেখা যায়। মাথার উপর লালটুপি আর তারের মতো দুটো লম্বা লেজ দেখলে এদের চিনতে অসুবিধা হয় না। ভারতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় মেঠো আবাবিল/ আবাবিল (ইংরেজি: Barn Swallow)পশ্চিমবঙ্গে দেখা মেলে অথচ বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যায় না এমন একটি পাখি পাথুরে চটি (Dusky Crag Martin)বৈজ্ঞানিক নাম: Ptyonoprogne concolor বা Hirundo concolor হিন্দী নাম:  চাতান-আবাবিল। এর বাংলায় কখনো নামকরণ হয়নি।

 





 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন