অধিবর্ষ বা লিপ ইয়ার :

অধিবর্ষ (ইংরেজি: Leap year) হচ্ছে একটি বিশেষ বছর, যাতে সাধারণ বছরের তুলনায় একটি দিন জোতির্বৈজ্ঞানিক বছরের সাথে সামাঞ্জস্য রাখার জন্য বেশি থাকে।
জোতির্বৈজ্ঞানিক বছর বা পৃথিবী যে সময়ে সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসে তার উপরই ঋতুর পরিবর্তন ও অন্যান্য মহাজাগতিক ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি নির্ভর করে। এর সময়কাল হচ্ছে প্রায় ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড, অথচ প্রচলিত গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিমতে বছর হিসাব করা হয় ৩৬৫ দিনে। এভাবে প্রতিবছর প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় গোনার বাইরে থেকে যায় ও চার বছরে সেটা প্রায় এক দিনের সমান হয়। এই ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য প্রতি চার বছর পরপর ৩৬৬ দিনে বছর হিসাব করা হয়।

খ্রিস্টপূর্ব  ৪৫ সালে জুলিয়াস সিজার লিপ ইয়ার ধারণার প্রবর্তন করেন। পূর্বে  রোমানদের ৩৫৫ দিনের ক্যালেন্ডার ছিল এবং বিভিন্ন উৎসব একই  ঋতুতে রাখার জন্য একটি ২২ অথবা ২৩ দিনের মাস প্রতি দ্বিতীয় বছরে যোগ করা হত। সিজার নিয়মটাকে সহজ করার জন্য বিভিন্ন মাসে দিন যোগ করে ৩৬৫ দিনের বছর সৃষ্টি করলেন। মূল গণনা করেন সিজারের জ্যোতির্বিজ্ঞানী  সোসিজেনেস। প্রতি বছরে ফেব্রুয়ারি মাসে ২৮তম দিনের পর একটি দিন যোগ করার নিয়ম করা হয়। অর্থাৎ প্রতি চতুর্থ বছরকে লিপ ইয়ার করা হয়। ১৫৮২ সালে পোপ অস্টম গ্রেগরী ক্যালেন্ডারটিকে পরিমার্জন করেন এই নিয়মে যে লিপ ইয়ার সে বছরগুলোতে আসবে যে সকল বছর  দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিভাজিত। কিন্তু যেহেতু একটি বছর ৩৬৫.২৫ দিনের চেয়ে একটু কম , প্রতি বছরে  দিন যোগ করার ফলে  ৪০০ বছরে প্রায়  ৩টি অতিরিক্ত দিনের সৃষ্টি হয়। তাই ৪টির মধ্যে কেবলমাত্র একটি শতাব্দী বছর লিপ ইয়ার হিসেবে পরিগণিত হয়। কারণে ১৭০০,১৮০০ ১৯০০ সাল লিপ ইয়ার ছিল না এবং ২১০০ সাল লিপ ইয়ার হবে না। কিন্তু ১৬০০ এবং ২০০০ লিপ ইয়ার ছিল কারণ ওই বছরগুলো ৪০০ দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিভাজিত

 

গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি :

এই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ৪ দিয়ে বিভাজ্য বছরগুলোকে অধিবর্ষ বলা হয়। যেমন: ২০০৪ সাল একটি অধিবর্ষ। তবে এই নিয়মের ব্যতিক্রমও আছে। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরতে একদম নিখুঁতভাবে ৩৬৫.২৫ দিন সময় নেয় না, একটু কম নেয়। তাই দেখা গেছে যে চার বছর পর পর অধিবর্ষ ধরলে প্রতি চারশ বছরে ৩ দিন সময় বেশি ধরা হয়ে যায়। এই সমস্যার সমাধানের জন্য যেসব বছর ১০০ দ্বারা বিভাজ্য, কিন্তু ৪০০ দ্বারা নয় তাদের অধিবর্ষের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। যেমন: ৪ দ্বারা বিভাজ্য হওয়া সত্ত্বেও ১৯০০ সাল অধিবর্ষ নয়। কারণ এটি ১০০ দ্বারা বিভাজ্য কিন্তু ৪০০ দ্বারা নয়।

বাংলা বর্ষপঞ্জি :

বাংলা বর্ষপঞ্জি, যা সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত হয়, তাতে অধিবর্ষের ধারণা দেখা যায় না। পরবর্তিতে বাংলাদেশে বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রস্তুত নতুন বর্ষপঞ্জিমতে বাংলা বর্ষপঞ্জিতেও গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসরণে ফেব্রুয়ারি মাসের সমসাময়িক বাংলা মাসে, সাধারণত ফাল্গুন মাসে, প্রতি চার বছর পর পর একবার অতিরিক্ত একটি দিন গণনা করা হয়। তবে ভারতে ও বাংলাদেশের হিন্দুগণ ধর্মীয় কারণে এই রীতি অনুসরণ করেন না। সনাতনী বাংলা বর্ষপঞ্জিতে অধিবর্ষ একটু জটিল নিয়মে আসে। এক্ষেত্রে সাল থেকে ৭ বিয়োগ করে ৩৯ দিয়ে ভাগ করতে হয়। যদি ভাগশেষ শূন্য বা চার দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হয় তবে ঐ সালকে অধিবর্ষ ধরা হয়। আর অধিবর্ষের অতিরিক্ত এক দিন চৈত্র মাসে যোগ হয়। এই হিসাব অনুযায়ী প্রতি ৩৯ বছরে ১০টি অধিবর্ষ আসে, যেটা জোতির্বৈজ্ঞানিক বর্ষপঞ্জির সাথে যথেষ্ট সামাঞ্জস্যপূর্ণ। তবে অতি লম্বা সময় ধরে এই নিয়ম অনুসরণ করে গেলে সম্ভবত সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে।
..................................................................

ভাষা শহীদ :


বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছিলেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। কেননা, ছাত্রবিক্ষোভের পর পুলিশের গুলিতে নিহত অনেকের লাশ ওই রাতেই পুলিশ এবং সেনাবাহিনী মর্গ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং গুম করে ফেলে। ভাষাশহীদদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা :
  • আবুল বরকত  
  • আব্দুল জব্বার
  • আব্দুস সালাম 
  • রফিকউদ্দীন আহমেদ
  • শফিউর রহমান 

আবুল বরকত :

আবুল বরকত (জন্ম: ১৬ই জুন, ১৯২৭ বাবলা গ্রাম, ভরতপুর, মুর্শিদাবাদ;  মৃত্যু: ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২) মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ। তাঁর শহীদস্মৃতি পরবর্তীকালে বাঙালি জাতিকে জাতীয় চেতনাবোধ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। চেতনার বলেই ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

শিক্ষাজীবন :

আবুল বরকতের পিতার নাম মরহুম শামসুদ্দিন, মাতার নাম হাসিনা বেগম। তাঁর জন্ম অবিভক্ত ভারতবর্ষের মুর্শিদাবাদ (বর্তমানে ভারতের একটি জেলা) জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে। শহীদ বরকত সেখানকার় তালিবপুর হাইস্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে মেট্রিক এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে আই.এ পাস করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ হয়ে বি.এ. অনার্স পাস করেন। অতঃপর স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে ভর্তি হন।

ভাষা আন্দোলন :

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ গুলি চালালে হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হন আবুল বরকত। ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ভর্তি অবস্থায় রাত আটটার দিকে মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যু পরবর্তী :


২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালের রাতে আবুল বরকতের আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে আজিমপুর গোরস্তানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আবদুস সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউর রহমান প্রমূখ শহীদদের অন্যতম তিনি।

সম্মাননা :

মহান ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগের জন্য ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার শহীদ বরকতকে একুশে পদক প্রদান করে।
..............................................................................................................


আবদুল জব্বার :

আবদুল জব্বার (জন্মঃ ২৬ আশ্বিন ১৩২৬ বাংলা, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ, পাঁচাইর গ্রাম, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ জেলা;  মৃত্যুঃ ২১শে ফেব্রুয়ারি,১৯৫২, ঢাকা) ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ। তাঁর শহীদস্মৃতি পরবর্তীকালে বাঙালি জাতিকে জাতীয় চেতনায় উজ্জ্বীবিত ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এ চেতনার বলেই ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

প্রাথমিক জীবন :

স্থানীয় ধোপাঘাট কৃষিবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুকাল অধ্যয়নের পরে দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া ত্যাগ করে পিতাকে কৃষিকাজে সাহায্য করেন আবদুল জব্বার। পনের বছরে নিজ খেয়ালে সবার অজান্তে গৃহত্যাগ করেন। নারায়ণগঞ্জে এসে সেখানে জাহাজ ঘাটে এক ইংরেজ সাহেবের সান্নিধ্যে আসেন। সাহেব তাঁকে একটি চাকরি দিয়ে বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার) পাঠান। সেখানে দশ-বারো বছর অবস্থান করেন।

ব্যক্তিগত জীবন :

আবদুল জব্বারের পিতার নাম হাসান আলী এবং মায়ের নাম সাফাতুন নেছা। তাঁর অন্য ভাইদের নাম হচ্ছে - আবদুল কাদের ও এ,এইচ,এম আসাদ(নয়ন) বার্মা থেকে দেশে ফিরে এসে আমেনা খাতুন নামে এক যুবতীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। আমেনাজব্বার দম্পতির নূরুল ইসলাম বাদল নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে জব্বারের মৃত্যুর পর আমেনা খাতুনকে বিয়ে করেন তার সহোদর আবদুল কাদের। আমেনা কাদের দম্পতির রফিকুল্লাহ, আতিকুল্লাহ ও রাশেদা খাতুন নামে তিন সন্তান রয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১ তারিখে হৃদরোগজনিত কারণে বিনা চিকিসায় মারা যান আমেনা খাতুন

ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ :

আবদুল জব্বারের পুত্র জন্ম হওয়ার কিছুকাল পরে তার শাশুড়ি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। শাশুড়িকে নিয়ে ১৯৫২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় আসেন। হাসপাতালে রোগী ভর্তি করে আবদুল জব্বার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রদের আবাসস্থল (ছাত্র ব্যারাক) গফরগাঁও নিবাসী হুরমত আলীর রুমে (২০/৮) উঠেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হলে, কি হয়েছে দেখবার জন্য তিনি রুম থেকে বের হয়ে আসেন। তখনই পুলিশ গুলি শুরু করে এবং জব্বার আহত হন। ছাত্ররা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিসকরা জব্বারকে মৃত ঘোষণা করেন। তাকে যারা হাসপাতালে নিয়ে যান, তাদের মধ্যে ছিলেন ২০/৯ নম্বর কক্ষের সিরাজুল হক।


সম্মাননা :

মহান ভাষা আন্দোলনে অনবদ্য ভূমিকা রাখায় আবদুল জব্বারকে বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করেন।

..............................................................................................................




আবদুস সালাম :

 

আবদুস সালাম জন্মঃ ১৯২৫ সালে ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামে (পরবর্তীতে তার নামানুসারে গ্রামের নামকরণ করা হয় সালামনগর);  মৃত্যুঃ এপ্রিল ৭, ১৯৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ। ভাষা রক্ষায় তাঁর অসামান্য ভূমিকা ও আত্মাহুতির কারণেই পরবর্তীকালে বাঙালি জাতিকে জাতীয় চেতনায় উজ্জ্বীবিত ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এ চেতনার ফলেই ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

পরিবার ও কর্মজীবন :

তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ ফাজিল মিয়া। আবদুস সালাম কর্মজীবনে তকালীন পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগের 'পিয়ন' হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঢাকার নীলক্ষেত ব্যারাকের ৩৬বি নং কোয়ার্টারে বাস করতেন।

ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ :

বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বায়ান্নোর ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নেন। পরে ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ এলোপাথাড়িভাবে গুলি চালালে আবদুস সালাম গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। দেড় মাস চিকিসাধীন থাকার পর ৭ এপ্রিল, ১৯৫২ তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

সম্মাননা :

·         * মহান ভাষা আন্দোলনে আবদুস সালাম অনবদ্য ভূমিকা রাখায় বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০০ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করেন ।
·         * ফেনী স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে ২০০০ সালে 'ভাষা শহীদ সালাম স্টেডিয়ামে' রূপান্তর করা হয়।
·         * দাগনভুঞা উপজেলা মিলনায়তনকে ২০০৭ সালে 'ভাষা শহীদ সালাম মিলনায়তন' করা হয়।
·         * তাঁর নিজ গ্রাম লক্ষ্মণপুরের নাম পরিবর্তন করে 'সালাম নগর' রাখা হয়।

..............................................................................................................



রফিকউদ্দিন আহমদ :

রফিকউদ্দিন আহমদ (জন্মঃ অক্টোবর ৩০, ১৯২৬ পারিল বলধারা গ্রাম, সিংগাইর, মানিকগঞ্জ;  মৃত্যুঃ ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২) তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ। 

প্রাথমিক জীবন ও পরিবার :

রফিক উদ্দিনের পিতার নাম আবদুল লতিফ ও মাতার নাম রাফিজা খাতুন। তাঁর পিতা আবদুল লতিফ ছিলেন ব্যবসায়ী, কলকাতায় ব্যবসা করতেন। রফিকউদ্দিনের শৈশবের পড়ালেখা শুরু কলকাতার 'মিত্র ইনস্টিটিউটে'এরপরে মানিকগঞ্জের 'বায়রা স্কুলে'১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রফিকউদ্দিনের পিতা ঢাকায় চলে আসেন। এখানে বাবুবাজারে আকমল খাঁ রোডে পারিল প্রিন্টিং প্রেস নামে ছাপাখানা চালু করেন। বায়রা স্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করে রফিকউদ্দিন মানিকগঞ্জ 'দেবেন্দ্রনাথ কলেজে' বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। আই.কম. ক্লাস পর্যন্ত পড়লেও পরে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় এসে পিতার সঙ্গে প্রেস পরিচালনা করতে শুরু করেন। পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। 

১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে :

বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র জনতার মিছিলে রফিক অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গনে পুলিশ গুলি চালালে সেই গুলি রফিকউদ্দিনের মাথায় লাগে। গুলিতে মাথার খুলি উড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। মেডিকেল হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্বদিকে তার লাশ পড়ে ছিল। ছয় সাত জন ধরাধরি করে তার লাশ এনাটমি হলের পেছনের বারান্দায় এনে রাখেন। তাদের মাঝে ডাঃ মশাররফুর রহমান খান রফিকের গুলিতে ছিটকে পড়া মগজ হাতে করে নিয়ে যান।

মৃত্যু পরবর্তী :

রাত তিনটায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় ঢাকার আজিমপুর গোরস্তানে শহীদ রফিকের লাশ দাফন করা হয়। রফিকউদ্দিন ও অন্যান্য ভাষা শহীদ - সালাম, জব্বার, শফিউরের মহান আত্মত্যাগের ফলেই বাংলা ভাষা ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি লাভ করে।
তাঁর শহীদ স্মৃতি উত্তরকালে পূর্ববঙ্গবাসীদের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এই চেতনার ভিত্তিতেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
..............................................................................................................
 

শফিউর রহমান :

শফিউর রহমান (জন্মঃ জানুয়ারি ২৪, ১৯১৮  -  মৃত্যুঃ ফেব্রুয়ারি ২২, ১৯৫২) মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ। 

সংক্ষিপ্ত জীবনী :

শফিউর রহমান বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার কোন্নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাহবুবুর রহমান ছিলেন ঢাকার পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ অফিসের সুপারিনটেনডেন্ট। কলকাতা গভর্ণমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ হতে আই.কম পাশ করে শফিউর রহমান চব্বিশ পরগণা সিভিল সাপ্লাই অফিসে কেরানীর চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতার তমিজউদ্দিনের কন্যা আকিলা খাতুনের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। দেশ বিভাগের পর পিতার সঙ্গে ঢাকায় এসে ঢাকা হাইকোর্টে হিসাব রক্ষণ শাখায় কেরানী পদে যোগ দেন।

যেভাবে শহীদ হলেন :

১৯৫২‌- ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল দশটার দিকে ঢাকার রঘুনাথ দাস লেনের বাসা থেকে সাইকেলে চড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হন শফিউর। সকাল সাড়ে দশটার দিকে নওয়াবপুর রোডে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্বদিনের পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ছাত্র জনতার বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ পুনরায় গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলি শফিউর রহমানের পিঠে এসে লাগে। আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচার সফল না হওয়ায় ঐদিন সন্ধ্যা সাতটায় মৃত্যুবরণ করেন।



দাফন :

কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে ২২ ফেব্রুয়ারি'র মধ্যরাতে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাঁর কবরের পাশেই রয়েছে পূর্বদিনের শহীদ আবুল বরকতের কবর।

একুশে পদক :

২০০৫ সালে তকালীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শফিউর রহমানকে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। এছাড়াও  ২০০৬ সালে অন্যান্য ভাষা আন্দোলনে শহীদ অন্যান্য পরিবারের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী বেগম আকিলা খাতুনকে আজীবন ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।

..............................................................................................................