ডেড সি (মৃত সাগর) :

মৃত সাগর ("Sea of Salt"; আরবি: ألبَحْر ألمَيّت, al-Baḥrᵘ l-Mayyit, "Dead Sea") এর পশ্চিমে পশ্চিম তীর এবং ইসরায়েল , পূর্বে জর্ডান। জিবুতির আসাল হ্রদের পর এটি বিশ্বের

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লবণাক্ত পানির প্রাকৃতিক আধার। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৪২০ মিটার (১,৩৭৮ ফিট) নিচে এটি পৃথিবীর নিম্নতম স্থলভূমি।  এর লবণাক্ততা শতকরা ৩০ ভাগ এবং এটি সমুদ্রের পানির চাইতে ৮.৬ গুণ বেশি লবণাক্ত।  ইসলাম ধর্মে মৃত সাগরের এলাকাকে পয়গম্বর হযরত লূতের (আঃ) জামানার সমকামী গোষ্ঠীর আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। 
সমকাম পরিত্যাগ করে লুত(আঃ)-এর আনুগত্য স্বীকারে অসম্মত হওয়ার কারণে এই স্থান উল্টে দিয়ে এ জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল


প্রাকৃতিক ইতিহাস :

প্রায় তিন মিলিয়ন বছর পূর্বে বর্তমান জর্দান নদী, মৃত সাগর এবং ওয়াদি আরাবাহ অঞ্চল লোহিত সাগরএর পানিতে বারবার প্লাবিত হত ।এর ফলে একটি সরু উপসাগরের সৃষ্টি হয় । উপসাগরটি জেজরিল উপত্যকায় একটি সরু সংযোগের মাধ্যমে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত ছিল ।

প্রাকৃতিক তত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে উপত্যকা এবং ভূমধ্যসাগরএর মধ্যবর্তী স্থলভাগ যথেষ্ট উচ্চতা লাভ করে । ফলে মহাসাগরের প্লাবনে এই অঞ্চলে সৃষ্ট উপসাগরটি পরিবেষ্টিত হয়ে হ্রদে পরিণত হয়।

৭০,০০০ বছর পূর্ব থেকে ১২,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত ডেড সি'র পানির উচ্চতা বর্তমান উচ্চতার চাইতে ১০০ থেকে ২৫০ মিটার বেশি ছিল । 
২৬,০০০ বছর পূর্বে এটির পানি সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে ।প্রায় ১০,০০০ বছর পূর্বে এর পৃষ্ঠ উচ্চতা নাটকীয় ভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে , যা সম্ভবত বর্তমান পৃষ্ঠ উচ্চতার চাইতেও কম ছিল ।গত কয়েক হাজার বছর ধরে এর পানির পৃষ্ঠ উচ্চতা মোটামুটি ৪০০ মিটারের আশেপাশে অবস্থান করছে



রাসায়নিক উপাদান :

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে , মহাসাগরের পানির তুলনায় ডেড সির পানিতে মিশে থাকা খনিজ উপাদানগুলোর পার্থক্য আছে । মৃত সাগরের পানিতে মিশে থাকা লবণে ১৪% ক্যালসিয়াল ক্লোরাইড , ৪% পটাশিয়াম ক্লোরাইড , ৫০% ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড এবং ৩০% সোডিয়াম ক্লোরাইড রয়েছে ।
 


অনেকে বিশ্বাস করেন , ডেড সি এর কাদা অনেক ধরণের রোগ নিরাময়ে সহায়ক

এর লবণাক্ততা শতকরা ৩০% । ফলে পানির ঘনত্ব ১.২৪ কেজি/লিটার ।উচ্চ প্লবতার দরুন যে কেউ মৃত সাগরের পানিতে ভেসে থাকতে পারে । এই আচরণ যুক্তরাষ্ট্র-এর ইউটাহ তে অবস্থিত গ্রেট সল্ট লেক এর মত ।





স্বাস্থ্যগত প্রভাব :

মৃত সাগর অঞ্চলটি চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণাস্থল হয়ে উঠেছে এর মূলে রয়েছে হ্রদের পানিতে খনিজ দ্রব্যাদির বিপুল উপস্থিতি, বাতাসে এলার্জি উৎপাদক দ্রব্য এবং পরাগরেণুর স্বল্পতা , উচ্চ ভূ-মন্ডলীয় চাপ, সৌর বিকিরণে অতি বেগুনি উপাদানের কম উপস্থিতি  
উচ্চ বায়ুমন্ডলীয় চাপ , শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা রোগীদের জন্য বেশ উপকারী।

চর্মরোগ সোরিয়াসিস ( psoriasis ) এর জন্য দীর্ঘসময় সূর্যস্নান বেশ উপকারী । এ অঞ্চলে অতি বেগুনি রশ্মির স্বল্পতা সূর্যস্নানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে । এছাড়া রোগটি নিরাময়ে জন্য মৃত সাগরের লবণও বেশ উপকারী



জীব ও উদ্ভিদ বৈচিত্র :

এ হ্রদে কোন উদ্ভিদ বা মাছ বাঁচে না বলেই মূলত একে মৃত সাগর বলা হয়ে থাকে । কেবল সামান্য কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক অণুজীবের সন্ধান পাওয়া যায় ।
ডেড সি তীরবর্তী পাহাড়ী অঞ্চলে উট , খরগোশ , খেকশিয়াল এমনকি চিতাবাঘ দেখতে পাওয়া যায়
অতীতে জর্দান নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে প্যাপিরাস এবং পাম গাছে সমৃদ্ধ বনভূমির অবস্থান ছিল । জোসেফাস তার লেখনীতে জেরিকো কে জুদিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে উর্বরভূমি রুপে উল্লেখ করেন । 
রোমান এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সময় ইক্ষু , সিকামোর এবং হেনা এ অঞ্চলের উদ্ভিদ বৈচিত্রে সমৃদ্ধি এনে দেয় । 
জেরিকোতে বালসাম গাছের রস থেকে প্রস্তুত করা হত উন্নত মানের পারফিউম এবং সুগন্ধি। ১৯ শতকের মধ্যে জেরিকোর উর্বরতা অতীত ইতিহাসে পরিণত হয়।



মানব সভ্যতার ইতিহাসে মৃত সাগর :


ইসলাম ধর্ম দর্শনে : ইসলাম ধর্মে এ অঞ্চলকে হযরত লূত (আঃ) এর অনুসারীদের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । সমকামের দরুণ এই জাতিকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন । আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ফেরেশতারা ভূমি উল্টে এ জাতিটিকে মাটি চাপা দেন । আল-ক্বুরআনে সূরা রুম এ ঘটনা উল্লেখ করা আছে । এর দরুন এ এলাকা কে বিশ্বের সবচেয়ে নিচু এলাকা বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে।


খ্রিস্ট ধর্ম : দুর্গম এ অঞ্চল বাইজেন্টাইন শাসকদের আমল থেকে গ্রিক অর্থোডক্স সন্নাসীদের আকৃষ্ট করতে শুরু করে ।ওয়াদি কেল্টে অবস্থিত সেইন্ট জর্জ গীর্জা এবং জুদাই মরুভূমিতে মারসাবা মন্দির খ্রিস্টানদের তীর্থস্থান


ইহূদী ধর্মে : মৃত সাগরের উত্তর তীরবর্তী "জেরিকো" শহরকে ইহূদী ধর্মগ্রন্থগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে । বুক অব জেনেসিস এ উল্লেখিত নবী আব্রাহামের সময়কালে ধ্বংসপ্রাপ্ত সোডম এবং গোমোরা শহর এবং তিনটি "সমতল ভুমির শহর" আদমাহ , জেবোইম এবং জোয়ার শহরের অবস্থান সম্ভবত মৃত সাগরের দক্ষিণপূর্ব উপকূলে।


মৃত সাগর সম্পর্কে ভবিষদ্বাণী :
বাইবেলএ মৃত সাগর লবণাক্ততা বিলুপ্ত হওয়ার সম্পর্কে ভবিষদ্বাণী রয়েছে । এজেকেইল এ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে "মৃত সাগরের পানি স্বাদু হয়ে যাবে, এমনকি মাছের বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠবে" জেকরিয়াহ তে উল্লেখ আছে "জেরুজালেমের পানি দু'ভাগে ভাগ হয়ে যাবে , একভাগ জমা হবে পূর্ব সাগরে(মৃত সাগর)" , অন্য ভাগ জমা হবে পশ্চিম সাগরে(ভূমধ্যসাগর


বর্তমান সময়ে :
বিশ্বের সবচেয়ে নিচু হাইওয়ে "হাইওয়ে ৯০" মৃত সাগরের প্বার্শে অবস্থিত সমুদ্র সমতল থেকে ৩৯৩ মিটার নিচে অবস্থিত এ হাইওয়েটি ইসারায়েল এবং পশ্চিম তীরের মধ্য দিয়ে চলে গেছে ।ব্রিটিশরা উত্তর উপকূলে গড়ে তুলেছিল "সোডম এবং গোমোরাহ" নামের একটি গলফ কোর্স ।
ইসরায়েলের আরাদ এর নিকটবর্তী অঞ্চলে প্রধান হোটেলগুলোর নির্মাণ শুরু হয় বিশ শতকের ৬০ এর দশক থেকে 
সমসাময়িককালে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের ফলে জর্ডান উপকূলও ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে ।




শিল্প :

২০০১ সালে মৃত সাগর থেকে প্রাপ্ত ব্রাইন থেকে ইসরায়েল ১.৭৭ মিলিয়ন টন পটাশ , ৪৪,৯০০ টন কস্টিক সোডা , ২০৬,০০০ টন ব্রোমিন এবং ২৫,০০০ টন ম্যাগনেসিয়াম ধাতু এবং সোডিয়াম ক্লোরাইড উৎপাদন করে । জর্ডান প্রান্তে ১৯৫৬ সালে স্থাপিত হয় আরব পটাশ (এপিসি) । 
এটি বাৎসরিক ২ মিলিয়ন টন পটাশ উৎপাদন করে । এছাড়া উৎপাদিত হয় সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং ম্যাগনিসয়াম।

  

  মৃত সাগরের ছবি :










 ........................................................




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন