বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছিলেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। কেননা, ছাত্রবিক্ষোভের পর পুলিশের গুলিতে নিহত অনেকের লাশ ওই রাতেই পুলিশ এবং সেনাবাহিনী মর্গ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং গুম করে ফেলে। ভাষাশহীদদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা :
- আবুল বরকত
- আব্দুল জব্বার
- আব্দুস সালাম
- রফিকউদ্দীন আহমেদ
- শফিউর রহমান
আবুল বরকত :
আবুল বরকত (জন্ম: ১৬ই জুন, ১৯২৭ বাবলা গ্রাম, ভরতপুর, মুর্শিদাবাদ; মৃত্যু: ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২) মহান ভাষা আন্দোলনের
অন্যতম শহীদ। তাঁর শহীদস্মৃতি পরবর্তীকালে বাঙালি জাতিকে জাতীয় চেতনাবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। এ চেতনার বলেই ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
শিক্ষাজীবন :
আবুল বরকতের পিতার
নাম মরহুম শামসুদ্দিন, মাতার নাম হাসিনা বেগম। তাঁর জন্ম অবিভক্ত ভারতবর্ষের মুর্শিদাবাদ (বর্তমানে ভারতের একটি জেলা) জেলার
ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে। শহীদ বরকত সেখানকার় তালিবপুর হাইস্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে
মেট্রিক এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে আই.এ পাস করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে
ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে
দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ হয়ে বি.এ. অনার্স পাস করেন। অতঃপর স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে
ভর্তি হন।
ভাষা আন্দোলন :
বাংলাকে পাকিস্তানের
অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের
সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ গুলি
চালালে হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হন আবুল বরকত। ঢাকা মেডিকেল
কলেজের হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ভর্তি অবস্থায় রাত আটটার দিকে মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যু পরবর্তী :
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালের রাতে আবুল বরকতের আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে
একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে আজিমপুর গোরস্তানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। মহান
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আবদুস সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউর রহমান
প্রমূখ শহীদদের অন্যতম তিনি।
সম্মাননা :
মহান ভাষা
আন্দোলনে আত্মত্যাগের জন্য ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার শহীদ বরকতকে একুশে পদক প্রদান
করে।
..............................................................................................................
আবদুল জব্বার :
আবদুল জব্বার (জন্মঃ ২৬ আশ্বিন ১৩২৬
বাংলা, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ, পাঁচাইর গ্রাম, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ জেলা; মৃত্যুঃ ২১শে ফেব্রুয়ারি,১৯৫২, ঢাকা) ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ। তাঁর
শহীদস্মৃতি পরবর্তীকালে বাঙালি জাতিকে জাতীয় চেতনায় উজ্জ্বীবিত ও দেশপ্রেমে
উদ্বুদ্ধ করে। এ চেতনার বলেই ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা
অর্জিত হয়।
প্রাথমিক জীবন :
স্থানীয় ধোপাঘাট
কৃষিবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুকাল অধ্যয়নের পরে দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া ত্যাগ করে পিতাকে
কৃষিকাজে সাহায্য করেন আবদুল জব্বার। পনের বছরে নিজ খেয়ালে সবার অজান্তে গৃহত্যাগ করেন। নারায়ণগঞ্জে এসে সেখানে জাহাজ ঘাটে এক ইংরেজ সাহেবের
সান্নিধ্যে আসেন। সাহেব তাঁকে একটি চাকরি দিয়ে বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার) পাঠান। সেখানে দশ-বারো বছর অবস্থান করেন।
ব্যক্তিগত জীবন :
আবদুল জব্বারের
পিতার নাম হাসান আলী এবং মায়ের নাম সাফাতুন নেছা। তাঁর অন্য ভাইদের নাম হচ্ছে - আবদুল কাদের ও এ,এইচ,এম আসাদ(নয়ন) বার্মা থেকে । দেশে ফিরে এসে আমেনা খাতুন নামে এক যুবতীর সাথে
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। আমেনাজব্বার দম্পতির নূরুল ইসলাম বাদল নামে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে জব্বারের মৃত্যুর পর আমেনা
খাতুনকে বিয়ে করেন তার সহোদর আবদুল কাদের। আমেনা কাদের দম্পতির রফিকুল্লাহ, আতিকুল্লাহ ও রাশেদা খাতুন নামে তিন সন্তান রয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১ তারিখে হৃদরোগজনিত কারণে বিনা চিকিৎসায় মারা যান
আমেনা খাতুন।
ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ :
আবদুল জব্বারের
পুত্র জন্ম হওয়ার কিছুকাল পরে তার শাশুড়ি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। শাশুড়িকে নিয়ে ১৯৫২ সালের ২০শে
ফেব্রুয়ারী ঢাকায় আসেন। হাসপাতালে রোগী ভর্তি করে আবদুল জব্বার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রদের আবাসস্থল (ছাত্র ব্যারাক) গফরগাঁও নিবাসী হুরমত আলীর
রুমে (২০/৮) উঠেন। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হলে, কি হয়েছে দেখবার জন্য তিনি রুম থেকে বের হয়ে আসেন। তখনই পুলিশ গুলি
শুরু করে এবং জব্বার আহত হন। ছাত্ররা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা জব্বারকে মৃত
ঘোষণা করেন। তাকে যারা হাসপাতালে নিয়ে যান, তাদের মধ্যে ছিলেন ২০/৯ নম্বর কক্ষের সিরাজুল হক।
সম্মাননা :
মহান ভাষা আন্দোলনে
অনবদ্য ভূমিকা রাখায় আবদুল জব্বারকে বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করেন।
..............................................................................................................
আবদুস সালাম :
পরিবার ও কর্মজীবন :
তাঁর পিতার নাম
মোহাম্মদ ফাজিল মিয়া। আবদুস সালাম কর্মজীবনে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগের 'পিয়ন' হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঢাকার নীলক্ষেত ব্যারাকের ৩৬বি নং কোয়ার্টারে বাস করতেন।
ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ :
বাংলা ভাষাকে
পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার
দাবিতে বায়ান্নোর
২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪
ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নেন। পরে ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ এলোপাথাড়িভাবে
গুলি চালালে আবদুস সালাম গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। দেড় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ৭ এপ্রিল, ১৯৫২ তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সম্মাননা :
·
* মহান ভাষা আন্দোলনে আবদুস সালাম অনবদ্য ভূমিকা রাখায় বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০০ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর)
প্রদান করেন ।
·
* ফেনী স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে ২০০০ সালে 'ভাষা শহীদ সালাম
স্টেডিয়ামে' রূপান্তর করা হয়।
·
* দাগনভুঞা উপজেলা মিলনায়তনকে ২০০৭ সালে 'ভাষা শহীদ সালাম
মিলনায়তন' করা হয়।
·
* তাঁর নিজ গ্রাম লক্ষ্মণপুরের নাম পরিবর্তন করে 'সালাম নগর' রাখা হয়।
..............................................................................................................
রফিকউদ্দিন আহমদ :
রফিকউদ্দিন আহমদ (জন্মঃ অক্টোবর ৩০, ১৯২৬ পারিল বলধারা গ্রাম, সিংগাইর, মানিকগঞ্জ; মৃত্যুঃ ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২) তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ।
প্রাথমিক জীবন ও পরিবার :
রফিক উদ্দিনের পিতার
নাম আবদুল লতিফ ও মাতার নাম রাফিজা খাতুন। তাঁর পিতা আবদুল লতিফ ছিলেন ব্যবসায়ী, কলকাতায় ব্যবসা করতেন। রফিকউদ্দিনের শৈশবের পড়ালেখা শুরু কলকাতার 'মিত্র ইনস্টিটিউটে'। এরপরে মানিকগঞ্জের 'বায়রা স্কুলে'। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রফিকউদ্দিনের পিতা ঢাকায় চলে আসেন। এখানে বাবুবাজারে আকমল খাঁ রোডে পারিল প্রিন্টিং প্রেস নামে ছাপাখানা চালু করেন। বায়রা স্কুল থেকে ১৯৪৯
সালে ম্যাট্রিক পাস করে রফিকউদ্দিন
মানিকগঞ্জ 'দেবেন্দ্রনাথ কলেজে' বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। আই.কম. ক্লাস পর্যন্ত পড়লেও পরে পড়াশোনা বন্ধ
হয়ে যায়। ঢাকায় এসে পিতার সঙ্গে প্রেস পরিচালনা করতে শুরু করেন। পরে
ঢাকার জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ
বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজের
হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে :
বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সম্মুখের রাস্তায় ১৪৪
ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শনরত ছাত্র জনতার মিছিলে রফিক অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গনে পুলিশ গুলি চালালে সেই
গুলি রফিকউদ্দিনের মাথায় লাগে। গুলিতে মাথার খুলি উড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই
তাঁর মৃত্যু হয়। মেডিকেল হোস্টেলের ১৭ নম্বর রুমের পূর্বদিকে তার লাশ পড়ে
ছিল। ছয় সাত জন ধরাধরি করে তার লাশ এনাটমি হলের পেছনের বারান্দায় এনে
রাখেন। তাদের মাঝে ডাঃ মশাররফুর রহমান খান রফিকের গুলিতে ছিটকে পড়া মগজ
হাতে করে নিয়ে যান।
মৃত্যু পরবর্তী :
রাত তিনটায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় ঢাকার আজিমপুর গোরস্তানে শহীদ রফিকের লাশ
দাফন করা হয়। রফিকউদ্দিন ও অন্যান্য ভাষা শহীদ - সালাম, জব্বার, শফিউরের মহান আত্মত্যাগের ফলেই বাংলা ভাষা ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রভাষা
হিসেবে শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতি লাভ করে।
তাঁর শহীদ স্মৃতি
উত্তরকালে পূর্ববঙ্গবাসীদের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত করার
ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এই চেতনার ভিত্তিতেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
..............................................................................................................
শফিউর রহমান :
শফিউর রহমান (জন্মঃ জানুয়ারি ২৪, ১৯১৮ - মৃত্যুঃ ফেব্রুয়ারি ২২, ১৯৫২) মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
শফিউর রহমান
বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের
হুগলী জেলার কোন্নগরে
জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাহবুবুর রহমান ছিলেন ঢাকার পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ অফিসের
সুপারিনটেনডেন্ট। কলকাতা গভর্ণমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ হতে আই.কম পাশ করে শফিউর রহমান চব্বিশ পরগণা
সিভিল সাপ্লাই অফিসে
কেরানীর চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতার তমিজউদ্দিনের কন্যা আকিলা খাতুনের
সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। দেশ বিভাগের পর পিতার সঙ্গে ঢাকায় এসে ঢাকা হাইকোর্টে হিসাব রক্ষণ শাখায় কেরানী পদে যোগ দেন।
যেভাবে শহীদ হলেন :
১৯৫২-র ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল
দশটার দিকে ঢাকার রঘুনাথ দাস লেনের বাসা থেকে সাইকেলে চড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হন শফিউর। সকাল
সাড়ে দশটার দিকে
নওয়াবপুর রোডে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে
পূর্বদিনের পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ছাত্র জনতার
বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ পুনরায় গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলি শফিউর রহমানের পিঠে এসে লাগে। আহত
অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়।
অস্ত্রোপচার সফল না হওয়ায় ঐদিন সন্ধ্যা সাতটায় মৃত্যুবরণ করেন।
দাফন :
কর্তৃপক্ষের
নির্দেশক্রমে ২২ ফেব্রুয়ারি'র মধ্যরাতে আজিমপুর
কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাঁর কবরের পাশেই রয়েছে পূর্বদিনের শহীদ আবুল বরকতের কবর।
একুশে পদক :
২০০৫ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শফিউর রহমানকে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। এছাড়াও ২০০৬ সালে অন্যান্য ভাষা আন্দোলনে শহীদ অন্যান্য পরিবারের
পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী বেগম আকিলা খাতুনকে আজীবন ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন