অগ্নিঝরা ১৯ শে মার্চ ১৯৭১, গাজীপুর :


অগ্নিঝরা ১৯ শে মার্চ, ১৯৭১ এর এই দিনে গাজীপুরে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ হয় শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে," জাগ্রত চৌরঙ্গী " আজ ও তাদের অটুট দৃঢ়চেতা মনোভাবের প্রতীক হিসেবে দাড়িয়ে আছে। ১৯ শে মার্চ এর সেই সকল শহীদ এর প্রতি রইল গভীর স্রদ্ধাঞ্জলি।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনা পর্বে গাজীপুরে (কালীন জয়দেবপুর) সংঘটিত হয় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালী জাতি সর্ব প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তখন দেশব্যাপী শ্লোগান উঠেছিল জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর১৯ মার্চ মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাহসী ভুমিকার কারণে সেদিন গাজীপুরের সর্বস্তরের জনতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেন। এ সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে পাক হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন হুরমত, নিয়ামত ও মনু খলিফা।

গাজীপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ীতে স্থাপন করা হয় তকালীন সেনানিবাসের ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তর। সে সময় জয়দেবপুর সেনানিবাসের অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল মাসুদ ও সহঅধিনায়ক ছিলেন মেজর কেএম শফিউল্লাহ। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার উদ্দেশ্যে ব্রিগেড কমান্ডার জাহানজেবের নেতৃত্বে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একদল সৈন্য জয়দেবপুর সেনানিবাসে আগমন করবে-এই খবর পেয়ে জয়দেবপুরের সর্বস্তরের জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা জয়দেবপুর, চান্দনা চৌরাস্তাসহ বিভিন্নস্থানে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে বাঁশের লাঠি ও বন্দুক নিয়ে সশস্ত্র গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

এই গণপ্রতিরোধের মুখে হানাদার বাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলিতে হুরমত আলী, নিয়ামত, মনু খলিফা শাহাদ বরণ করেন। কানু মিয়া ও সন্তোষসহ বহু লোক আহত হন। পরে চিকিসাধীন অবস্থায় মারা যান কানু মিয়া।

নেতৃবৃন্দের পরামর্শে ছাত্র, শ্রমিক, জনতা পাক হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধকল্পে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার রাস্তায় বহু সংখ্যক ব্যারিকেড তৈরি করে। দুপুরের দিকে পাক হানাদার বাহিনী চান্দনা চৌরাস্তায় উপস্থিত লোকজনকে অস্ত্রের মুখে ব্যারিকেড সরাতে বাধ্য করে সেনানিবাসে প্রবেশ করলে বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা পুনরায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। ছাত্র জনতা জয়দেবপুর রেলওয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে মালগাড়ীর ওয়াগান ফেলে বন্দুক ও বাঁশের লাঠি নিয়ে এবং একইভাবে চান্দনা চৌরাস্তায় বন্দুক ও বাঁশের লাঠি নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেনানিবাস থেকে ফেরার পথে লেভেল ক্রসিংয়ে পাক হানাদার বাহিনী উপস্থিত হলেই স্থানীয় সাহসী বীরদের বন্দুক গর্জে ওঠে। পাক হানাদার বাহিনীর প্রতি মরহুম কাজী আজিমউদ্দিন আহমেদ (মাস্টার (স্বীয় বন্দুক দিয়ে প্রথম গুলিবর্ষণ করেন। ঐ সময় হানাদার বাহিনী পাল্টা গুলিবর্ষণ করলে নিয়ামত, মনু খলিফা শহীদ হন এবং সন্তোষসহ বহু লোক আহত হন। জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড থাকায় হানাদার বাহিনী পাঁয়ে হেঁটে চৌরাস্তায় উপস্থিত হলে আব্দুস সাত্তার মিয়ার নেতৃত্বে স্থানীয় ছাত্র জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে তারা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এখানে গুলিতে হুরমত শহীদ হন এবং কানুমিয়াসহ অনেকে আহত হন। চিকিসাধীন অবস্থায় পরে কানু মিয়া মারা যান। ১৯ মার্চের বীরত্ব গাঁথা এ প্রতিরোধ সংগ্রামের পরই সারা বাংলায় শ্লোগান উঠে জয়দেবপুরের পথ ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর

স্বাধীনতার আন্দোলন এগিয়ে নিতে এই এলাকায় ওই সময় গাজীপুরের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা মরহুম শামসুল হক হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিরোধ করার লক্ষে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতাকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ২ মার্চ এক সভায় তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি হাইকমাণ্ড ও নয় সদস্যের মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের হাই কমান্ডে ছিলেন-মরহুম হাবিব উল্লাহ এমপি, প্রয়াত ডা. মনীন্দ্র নাথ গোস্বামী ও মরহুম এম এ মুত্তালিব। গাজীপুরের বর্তমান সংসদ সদস্য আ ক ম মোজাম্মেল হককে আহবায়ক ও বর্তমান বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা নজরুল ইসলাম খানকে কোষাধ্যক্ষ করে নয় সদস্য বিশিষ্ট মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন শহীদুল্লাহ বাচ্চু, শেখ আবুল হোসাইন, আব্দুস ছাত্তার মিয়া, শহীদুল ইসলাম পাঠান জিন্নাহ ও হারুন-অর-রশিদ।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯ মার্চকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তকালীন ১৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের উদ্যোগে ঢাকা-ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল ও গাজীপুর সড়কের মিলনস্থল চান্দনা চৌরাস্তায় মুক্তিযোদ্ধার প্রতীক (এক হাতে রাইফেল অপর হাতে গ্রেনেড) সংবলিত দেশের সর্বোচ্চ মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য জাগ্রত চৌরঙ্গীনির্মাণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য জাগ্রত চৌরঙ্গী নির্মাণ করা হয়। এই ভাস্কর্যটি এখনো দূর-দূরান্তের লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রতিবছরই যথাযোগ্য মর্যাদায় এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

...........................................................................

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন