বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের জন্ম
৮ই মার্চ ১৯৪৯
সালে বরিশাল জেলার
বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর
ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামে৷ তাঁর
পিতা আবদুল মোতালেব হাওলাদার৷ তাঁর
দাদা আবদুর রহিম
হাওলাদার একজন প্রতাপশালী ও
সম্মানী ব্যক্তি ছিলেন৷
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ছাত্র
হিসেবে ছিলেন বেশ
মেধাবী ৷ তিনি
খুবই কম কথা
বলতেন এবং বেশ
পরোপকারী ছিলেন৷ খেলাধুলার পাশাপাশি তিনি
রাজনীতি সচেতন ছিলেন৷
কলেজ জীবনেই তিনি
পাঠ করেন লেনিন,
মাও-সেতুং, চে
গুয়েভারা মতো ব্যক্তির সংগ্রামী জীবনের
গল্প ও রাজনৈতিক দর্শন৷
জাহাঙ্গীর আইএসসি পাস
করেন ১৯৬৬ সালে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই তিনি
যোগ দেন পাকিস্তান সামরিক
একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে৷ ১৯৬৮
সালের জুন মাসে
তিনি লাভ করেন
ইঞ্জিনিয়ার্স কোরে কমিশন্ড প্রাপ্ত হন৷
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু
হওয়ার সময়ে তিনি
পশ্চিম পাকিস্তানের কাবাকোরাম এলাকায়
১৭৩ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নে বহাল
ছিলেন৷ সেই সময়
পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালিদের পাখির
মতো মারছে৷ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর পশ্চিম
পাকিস্তানে বসে সেগুলো
শুনছিলেন আর কীভাবে
দেশে আসা যায়
ভাবছিলেন ৷ তাঁর
নিদ্রা পালিয়েছিল চোখ
থেকে৷ পশ্চিম পাকিস্তানে আটকেপড়া তাঁর
অন্যান্য বন্ধুও খুঁজছিলেন পালানোর উপায়৷
অন্যান্য বাঙালি তরুণ
অফিসারও পালানোর পথ
খুঁজছেন৷ ৩ জুলাই
১৯৭১৷ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ,
ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশিদ
খান, ক্যাপ্টেন আব্দুল
আজিজ পাশা এবং
ক্যাপ্টেন আনাম শিয়ালকোটের কাছে
সীমান্ত পেরিয়ে পালাতে
সক্ষম হন৷ জাহাঙ্গীর এর
আগে এদের কাউকেই
চিনতেন না৷ তাঁর
বন্ধু ক্যাপ্টেন হামিদের সহায়তায় এদের
সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র
হয়৷ অনেক কষ্টে
বিভিন্ন চরাই উৎরাই পার
হয়ে বৃষ্টি-বাদল
উপেক্ষা করে শিয়ালকোট থেকে
তাঁরা ভারতের উদ্দেশ্য পাকিস্তানীদের চোখ
ফাকি দিয়ে মাত্র
সঙ্গে একটি পিস্তলকে সঙ্গী
করে শেষ পর্যন্ত পা
রাখতে পারলেন ভারতের
মাটিতে৷ প্রথমেই গেলেন
নিকটবর্তী বিএসএফের ব্যাটালিয়ান হেড
কোয়ার্টারে৷ সেখান থেকে
দিলি্ল, অতঃপর কলকাতা৷ পশ্চিম
পাকিস্তান থেকে চারজন
বাঙালি সামরিক অফিসার
পালিয়ে এসেছেন শুনে
বাঙালি, মুক্তিবাহিনী ও
বাঙালি শরণার্থীদের প্রাণে
বিপুল উত্সাহ জাগল৷
মুক্তিযুদ্ধের
চিফ কমান্ডার কর্নেল
ওসমানী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে
কলকাতায় এলেন এই
পাঁচ বীরকে অভ্যর্থনা দেয়ার
জন্য৷
কলকাতা থেকেই পাঁচ ক্যাপ্টেনের বিচ্ছিন্নতা৷ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ৭নং সেক্টরে, যোগ দিলেন মেহেদীপুরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে৷ ক্যাপ্টেন আনাম ৪নং সেক্টরে, সিলেট রণাঙ্গনে৷ মেহেদীপুরের অদূরেই বয়ে চলেছে মহানন্দা নদী৷ মেহেদীপুর ক্যাম্পের দায়িত্ব পেয়েছেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর৷ বয়স মোটে তেইশ৷ তারুণ্যে টগবগ করে ফুটছেন তিনি৷ দৃঢ় প্রত্যয়ের এক অসম্ভব লড়াকু মানুষ৷ পরিধানে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, মাথায় লাল গামছা, পায়ে ক্যানভাসের জুতো৷ এই তরুণ সেক্টর কমান্ডারকে দেখে মেহেদীপুর মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা প্রথমে আঁচ করতে পারেনি কতটা ইস্পাতকঠিন তাঁর মন, কতটা বলিষ্ঠ তাঁর স্বভাব৷ তাঁর কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং ক্লান্তিহীন অধ্যবসায় তাঁর অল্প বয়স আর বাচ্চা বাচ্চা চেহারাটাকে অতিক্রম করে পরিণত করেছে এক প্রবল ব্যক্তিত্বে৷ তাঁর নামে সবাই এক ডাকে দাঁড়িয়ে যায়৷
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১৷ বাংলাদেশ জুড়ে সব ফ্রন্টে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হলো চূড়ান্ত লড়াই৷ মেহেদীপুর ক্যাম্পেও প্রস্তুতি শুরু হলো৷ এরই মধ্যে কোথাও কোথাও হানা দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা৷ যেন পরীক্ষা করে নিয়েছে নিজেদের শক্তি৷ এখন প্রস্তুতি শুরু চূড়ান্ত লড়াইয়ের৷ মহানন্দা নদীর অপর পারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর৷ সেখানে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে আছে পাকিস্তানি হানাদাররা৷ সে ঘাঁটি আগলাতেই নদীর তীর ঘেঁষে তারা তৈরি করে রেখেছে প্রতিরক্ষা দুর্গ৷ জনশূন্য চারদিকে৷ ঝোপঝাড়, গাছপালায় ভরা এই প্রতিরক্ষা দুর্গ৷ সেখানে তাদের হটানোর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের উপর৷
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর৷ লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম, লেফটেন্যান্ট আউয়ালসহ ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একটি আক্রমণের উদ্যোগ নিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর৷ বেশ কয়েকটা নৌকায় তাঁরা উজানে পাড়ি জমালেন ৷ ভোররাত৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়া৷ সেখানে অবস্থান নিয়ে পরিকল্পনা করা হলো হানাদার বাহিনীকে মিত্রবাহিনী দিয়ে গোলাবর্ষণ করে বিভ্রান্ত করে দেয়ার৷ এই অপ্রস্তুত অবস্থাতে আক্রমণ চালাবে মুক্তিবাহিনী৷ কিন্তু মিত্রবাহিনী গোলাবর্ষণ না করার ফলে মুক্তিবাহিনী নতুন কৌশল পরিকল্পনা করল৷
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১৷ ভোরারাত৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জকে দখল করার জন্য শুরু হলো চূড়ান্ত অপারেশন৷ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর জানতেন এটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান, জানতেন সহকর্মীরাও৷ তাই তিনি সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করলেন এই অভিযানে কারা তাঁকে সঙ্গ দিবেন৷ সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা তিনি সঙ্গীদের দিয়েছিলেন৷ মাত্র ২০ জন তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন৷ ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তিনি রওনা দিলেন৷ শীতের শেষ রাত৷ প্রচণ্ড শীতে হাত-মুখ জমে যাচ্ছে৷ রেহাইচর এলাকা দিয়ে তাঁরা মহানন্দা নদী পায়ে হেঁটে পাড়ি দিলেন৷ উত্তর দিক দিয়ে আক্রমণের সূচনা করা হলো ৷ অতর্কিত হামলা করে বেয়নেটের মাধ্যমে খতম করতে করতে তাঁরা এগোতে লাগলেন দক্ষিণ দিকে৷ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এমনভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন যাতে উত্তর থেকে শত্রু নিধন করার সময় শত্রু দক্ষিণ দিক থেকে গুলি করতে না পারে৷ সম্মুখ ও হাতাহাতি যুদ্ধ ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে৷ আর মাত্র কয়েকটা বাঙ্কারের পাকসেনা বাকি৷ তখনই দেখা দিল সমস্যা৷ পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের কয়েকজন সৈন্য বাঁধের ওপর ছিল তারা ব্যাপারটা টের পেয়ে গেল৷ তারা যোগ দিল পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে৷ এরপরই পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করে দিল গুলিবর্ষণ৷ কিন্তু জাহাঙ্গীর পিছু হটতে নারাজ৷ তিনি ভয়ে ভীত নন৷ তিনি সবাইকে নির্দেশ দিলেন এগিয়ে যাওয়ার জন্য৷ পাশাপাশি তিনি নিজেও এগিয়ে যেতে লাগলেন সামনের দিকে৷ তিনি হয়ে উঠলেন অদম্য দুঃসাহসী৷
হঠাৎ একটা গুলি এসে পড়ল সরাসরি ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কপালে৷ মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এই অসম সাহসী যোদ্ধা৷ হানাদারদের বেপোরোয়া গুলি বর্ষণের সামনে টিকতে পারলেন না তাঁর বাকি সহযোদ্ধারাও৷ তাঁরা পিছু হটলেন, নদীতে দিলেন ঝাঁপ৷ ডুব-সাঁতার দিয়ে চলে গেলেন নিরাপদ দূরত্বে৷ প্রচণ্ড শীতে তাঁরা নদী পাড়ি দিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় হাজির হলেন মেহেদীপুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে৷ শোকের মাতম উঠল চারদিকে৷ দিকে দিকে রটে গেল ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের শহীদ হবার সংবাদ৷ মুক্তিবাহিনীর সব সদস্য দ্রুত এই শোককে শক্তিতে পরিণত করে প্রতিশোধের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন৷ তাঁদের প্রবল আক্রমণের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হলো বর্বররা৷ মুক্ত হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ৷
ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের রক্তক্ষরা নিষপ্রাণ দেহ নদীর পাড় থেকে উদ্ধার করে সম্মাননার মধ্য দিয়ে সমাহিত করা হলো গৌড়ের ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে৷ আজও ধীরে বহে সেই মহানন্দা তার ঢেউয়ে ঢেউয়ে উচ্চারণ করে যায় বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নাম৷ স্বাধীনতার মাত্র ২ দিন পূর্বে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে এই মহান বীর দেশের জন্য শহীদ হলেন।
[ছবি ও তথ্য সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, ইন্টারনেট, বাংলা উইকিপিডিয়া,প্রথম আলো ব্লগ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন গবেষনাপত্র।]
কলকাতা থেকেই পাঁচ ক্যাপ্টেনের বিচ্ছিন্নতা৷ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ৭নং সেক্টরে, যোগ দিলেন মেহেদীপুরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে৷ ক্যাপ্টেন আনাম ৪নং সেক্টরে, সিলেট রণাঙ্গনে৷ মেহেদীপুরের অদূরেই বয়ে চলেছে মহানন্দা নদী৷ মেহেদীপুর ক্যাম্পের দায়িত্ব পেয়েছেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর৷ বয়স মোটে তেইশ৷ তারুণ্যে টগবগ করে ফুটছেন তিনি৷ দৃঢ় প্রত্যয়ের এক অসম্ভব লড়াকু মানুষ৷ পরিধানে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, মাথায় লাল গামছা, পায়ে ক্যানভাসের জুতো৷ এই তরুণ সেক্টর কমান্ডারকে দেখে মেহেদীপুর মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা প্রথমে আঁচ করতে পারেনি কতটা ইস্পাতকঠিন তাঁর মন, কতটা বলিষ্ঠ তাঁর স্বভাব৷ তাঁর কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং ক্লান্তিহীন অধ্যবসায় তাঁর অল্প বয়স আর বাচ্চা বাচ্চা চেহারাটাকে অতিক্রম করে পরিণত করেছে এক প্রবল ব্যক্তিত্বে৷ তাঁর নামে সবাই এক ডাকে দাঁড়িয়ে যায়৷
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১৷ বাংলাদেশ জুড়ে সব ফ্রন্টে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হলো চূড়ান্ত লড়াই৷ মেহেদীপুর ক্যাম্পেও প্রস্তুতি শুরু হলো৷ এরই মধ্যে কোথাও কোথাও হানা দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা৷ যেন পরীক্ষা করে নিয়েছে নিজেদের শক্তি৷ এখন প্রস্তুতি শুরু চূড়ান্ত লড়াইয়ের৷ মহানন্দা নদীর অপর পারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর৷ সেখানে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে আছে পাকিস্তানি হানাদাররা৷ সে ঘাঁটি আগলাতেই নদীর তীর ঘেঁষে তারা তৈরি করে রেখেছে প্রতিরক্ষা দুর্গ৷ জনশূন্য চারদিকে৷ ঝোপঝাড়, গাছপালায় ভরা এই প্রতিরক্ষা দুর্গ৷ সেখানে তাদের হটানোর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের উপর৷
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর৷ লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম, লেফটেন্যান্ট আউয়ালসহ ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একটি আক্রমণের উদ্যোগ নিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর৷ বেশ কয়েকটা নৌকায় তাঁরা উজানে পাড়ি জমালেন ৷ ভোররাত৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়া৷ সেখানে অবস্থান নিয়ে পরিকল্পনা করা হলো হানাদার বাহিনীকে মিত্রবাহিনী দিয়ে গোলাবর্ষণ করে বিভ্রান্ত করে দেয়ার৷ এই অপ্রস্তুত অবস্থাতে আক্রমণ চালাবে মুক্তিবাহিনী৷ কিন্তু মিত্রবাহিনী গোলাবর্ষণ না করার ফলে মুক্তিবাহিনী নতুন কৌশল পরিকল্পনা করল৷
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১৷ ভোরারাত৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জকে দখল করার জন্য শুরু হলো চূড়ান্ত অপারেশন৷ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর জানতেন এটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান, জানতেন সহকর্মীরাও৷ তাই তিনি সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করলেন এই অভিযানে কারা তাঁকে সঙ্গ দিবেন৷ সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা তিনি সঙ্গীদের দিয়েছিলেন৷ মাত্র ২০ জন তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন৷ ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তিনি রওনা দিলেন৷ শীতের শেষ রাত৷ প্রচণ্ড শীতে হাত-মুখ জমে যাচ্ছে৷ রেহাইচর এলাকা দিয়ে তাঁরা মহানন্দা নদী পায়ে হেঁটে পাড়ি দিলেন৷ উত্তর দিক দিয়ে আক্রমণের সূচনা করা হলো ৷ অতর্কিত হামলা করে বেয়নেটের মাধ্যমে খতম করতে করতে তাঁরা এগোতে লাগলেন দক্ষিণ দিকে৷ ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এমনভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন যাতে উত্তর থেকে শত্রু নিধন করার সময় শত্রু দক্ষিণ দিক থেকে গুলি করতে না পারে৷ সম্মুখ ও হাতাহাতি যুদ্ধ ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে৷ আর মাত্র কয়েকটা বাঙ্কারের পাকসেনা বাকি৷ তখনই দেখা দিল সমস্যা৷ পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের কয়েকজন সৈন্য বাঁধের ওপর ছিল তারা ব্যাপারটা টের পেয়ে গেল৷ তারা যোগ দিল পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে৷ এরপরই পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করে দিল গুলিবর্ষণ৷ কিন্তু জাহাঙ্গীর পিছু হটতে নারাজ৷ তিনি ভয়ে ভীত নন৷ তিনি সবাইকে নির্দেশ দিলেন এগিয়ে যাওয়ার জন্য৷ পাশাপাশি তিনি নিজেও এগিয়ে যেতে লাগলেন সামনের দিকে৷ তিনি হয়ে উঠলেন অদম্য দুঃসাহসী৷
হঠাৎ একটা গুলি এসে পড়ল সরাসরি ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কপালে৷ মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এই অসম সাহসী যোদ্ধা৷ হানাদারদের বেপোরোয়া গুলি বর্ষণের সামনে টিকতে পারলেন না তাঁর বাকি সহযোদ্ধারাও৷ তাঁরা পিছু হটলেন, নদীতে দিলেন ঝাঁপ৷ ডুব-সাঁতার দিয়ে চলে গেলেন নিরাপদ দূরত্বে৷ প্রচণ্ড শীতে তাঁরা নদী পাড়ি দিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় হাজির হলেন মেহেদীপুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে৷ শোকের মাতম উঠল চারদিকে৷ দিকে দিকে রটে গেল ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের শহীদ হবার সংবাদ৷ মুক্তিবাহিনীর সব সদস্য দ্রুত এই শোককে শক্তিতে পরিণত করে প্রতিশোধের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন৷ তাঁদের প্রবল আক্রমণের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হলো বর্বররা৷ মুক্ত হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ৷
ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের রক্তক্ষরা নিষপ্রাণ দেহ নদীর পাড় থেকে উদ্ধার করে সম্মাননার মধ্য দিয়ে সমাহিত করা হলো গৌড়ের ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে৷ আজও ধীরে বহে সেই মহানন্দা তার ঢেউয়ে ঢেউয়ে উচ্চারণ করে যায় বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নাম৷ স্বাধীনতার মাত্র ২ দিন পূর্বে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে এই মহান বীর দেশের জন্য শহীদ হলেন।
[ছবি ও তথ্য সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, ইন্টারনেট, বাংলা উইকিপিডিয়া,প্রথম আলো ব্লগ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বিভিন্ন গবেষনাপত্র।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন