মেহেদি এক ধরনের সপুষ্পক উদ্ভিদ এর আদি নিবাস উত্তর আফ্রিকা
ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া। গুল্মজাতীয়, শাখা প্রশাখা যুক্ত চিরসবুজ এই গাছটি আট ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। শীতকালে শাখা-প্রশাখার মাথায় সাদা কিংবা হালকা গোলাপি রঙের থোকা থোকা অসংখ্য
ফুল ফোটে। ফল মটরদানার মতো গোল।
মেহেদি গাছের পাতা
প্রাচীনকাল থেকে ত্বক, চুল, নখ, পশুর চামড়া ও পশম রঙিন করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই উদ্ভিদের পাতার সাথে অন্যান্য দ্রব্য মিশিয়ে আধা-কৃত্রিম
পদার্থ তৈরি করা হয়, সেটাও মেহেদি নামেই পরিচিত।
প্রাচীন মিশরের মেয়েরা
হাতে, পায়ে ও চুলে মেহেদি লাগাতো। বাগদাদের খলিফাদের যুগে নারীর সৌন্দর্য চর্চার অন্যতম প্রধান
উপকরণ ছিলো এই মেহেদি। উপমহাদেশে মোঘল রমণীদের সৌন্দর্য চর্চায় মেহেদির ভূমিকা ছিলো অনন্য। সম্রাজ্ঞী নূর-জাহান মেহেদির নকশী কাজ খুবই পছন্দ করতেন। মোঘল হেরেম থেকে রাজপুত নারীদের মধ্যে মেহেদির প্রচলন শুরু হয়
এবং এরপর তা ক্রমান্বয়ে উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
ব্যবহার :
ঈদ, বিয়ে ও নানা উৎসবে বিশেষ সাজগোজের
মধ্যে মেহেদি একটা বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। হাত, মাথার চুল রাঙাতে বৈচিত্র্যময় আল্পনায় ব্যবহৃত হয় মেহেদি। সৌন্দর্য চর্চায় অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের মতো মেহেদির ব্যবহারও
সার্বজনীন।
মেহেদির নানা প্রকার
ঔষধি গুণাগুণও রয়েছে হাত-পায়ের যত্নে, চুল ওঠে যাওয়া এবং পেকে যাওয়ার কার্যকর ওষুধ হচ্ছে মেহেদি। মেহেদি লাগালে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে চুল পড়ার হার কমে এবং
চুল পাকা বিলম্বিত হয়। এক মুঠো মেহেদি পাতার সঙ্গে একটি হরিতকী সামান্য বেটে প্রথমে পানিতে সেদ্ধ ও পরে
ঠাণ্ডা করে মাথায় লাগালে চুল পড়া কমে যায়। তবে এই ওষুধটি সপ্তাহে দু'বার লাগাতে হয়।
মেহেদির মূল রাসায়নিক
উপাদানের নাম ‘লওসন’। মেহেদি গাছের শুকনো পাতায় এক থেকে দেড় শতাংশ লওসন থাকে। রসায়নশাস্ত্রে এই রাসায়নিকের নাম ‘হাইড্রক্সি-ন্যাপথোকুইনোন’। মালয়েশিয়ায় মেহেদি পাতার নির্যাস বেরিবেরি, বাত, পেটের গোলমাল ও চামড়ার রোগে ব্যবহার করা হয়। ইন্দোনেশিয়ায় মেহেদি পাতা জণ্ডিস ও কুষ্ঠরোগে কাজে লাগে। জাভার অনেক মানুষ হার্পিস রোগ নিরাময়েও এই গাছের শরণাপন্ন হন। কম্বোডিয়ায় মূত্র-রোগ নিরাময়ে মেহেদি গাছের পাতা ব্যবহারের চল
আছে। আরবি চিকিৎসাশাস্ত্রে জণ্ডিস ও স্নায়ুরোগে এই গাছের ছালের নির্যাস ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া
যায়। মেহেদি গাছের বীজ থেকে
তৈরি তেলও মুখের ভেতরের ঘা এবং লিভারের অসুখে ব্যবহৃত হয়।
মেহেদি লাগানো :
হাতে মেহেদি লাগানো
কঠিন কাজ নয়। সাধারণভাবে আমাদের দেশের মেয়েরা টাটকা মেহেদি পাতা মিহি করে বেটে নেয়। টাটকা মেহেদি পাতা যোগাড় করতে অসুবিধা হলে আপনি টাটকা পাতা রোদে
শুকিয়ে গুঁড়ো করে চেলে শিশিতে ভরে কিংবা পলিথিন প্যাকে মুখ আটকে রেখে দিতে পারেন। প্রয়োজনে একটু গরম পানি দিয়ে পেস্টের মতো বানিয়ে হাতে নিজের
ইচ্ছেমতো ডিজাইন করে নিতে পারেন। এছাড়া বাজারে আজকাল গুঁড়ো মেহেদি এবং লিকুইড মেহেদিও পাওয়া যায়। তা দিয়েও হাত রাঙাতে পারেন। তবে তাজা মেহেদির রঙের উজ্জ্বলতাই ভিন্ন। আজকাল কম সময়ে সূক্ষ্ম
ডিজাইন করার জন্যে প্লাস্টিক কোণ ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিক কোণ বানানো এমন কঠিন কিছু নয়। আপনি নিচের ছবি দেখে অনায়াসে নিজেই এই কোণ বানাতে পারেন।
মেহেদির পেস্ট বানানো:
১. শুধু পরিষ্কার কাঁচা
পাতা মিহি করে বেটে নিতে পারেন।
২. মিহি করে বাটা কাঁচা
পাতার পেস্টের সাথে একটু লেবুর রস মিশিয়ে নিতে পারেন।
৩. কাঁচা পাতার পেস্টের
সাথে চা বা কফির কড়া লিকার মেশাতে পারেন। এতে মেহেদির রং গাঢ় হয়।
৪. কাঁচা পাতার পেস্টের
সাথে সামান্য পান খাওয়ার খয়ের মেশাতে পারেন। এতেও রং গাঢ় হবে।
৫. মেহেদি পাতার শুকনো
গুঁড়ো হলে তা পেস্টে পরিণত করার জন্যে একটু গরম পানিতে মিশিয়ে ১ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। তাহলেই পেস্ট ব্যবহারের উপযোগী হবে।
৬. গুঁড়ো পেস্টের সাথেও
লেবুর রস, চা বা কফির লিকার বা খয়ের মেশাতে পারেন।
৭. পেস্টের ঘনত্ব ঠিক
করার জন্যে প্রয়োজনমতো লেবুর রস ও একটু চিনি গোলানো পানি পেস্টের সাথে মিশিয়ে নিতে
পারেন।
মেহেদি লাগানোর পর
যদি দেখেন উঠে যেতে চায় তাহলে লেবুর রস ও চিনি গোলা পানি ভিন্ন পাত্রে নিয়ে তুলোতে
ভিজিয়ে মেহেদির প্রলেপের ওপর আস্তে আস্তে চেপে চেপে দেবেন। এতে পেস্ট ঝরে পড়বে না। দুই থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত মেহেদি হাতে রাখা উচিত। পুরো মেহেদি শুকিয়ে যাবার পর ভোঁতা ছুরি কিংবা চামচ দিয়ে তুলে
ফেলবেন। এবার খাঁটি সরিষার তেল মেখে হাত দুটো চুলোর আগুনের কাছে ধরে ২/৩ মিনিট সেকে নিন। খেয়াল রাখবেন সেকতে গিয়ে আবার হাত পুড়ে না ফেলেন। রঙের ঔজ্জ্বল্য ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্যে ২/৩ ঘণ্টা পানিতে
হাত ভেজাবেন না।